রোজার প্রয়োজনীয় সব পণ্যের দামই চড়া

অনলাইন ডেস্ক

দুয়ারে কড়া নাড়ছে পবিত্র মাহে রমজান মাস। এরই মধ্যে রোজার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন ধর্মপ্রাণ মানুষ। তবে এবার রোজা ঘিরে প্রয়োজনীয় প্রায় সব নিত্যপণ্য গত বছরের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। গত এক বছরের ব্যবধানে রাজধানীর খুচরা বাজারগুলোতে ছোলা, খেজুর, মসুর ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, বেসন, মাছ ও মাংসের দাম কেজিতে ৪ থেকে ১৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

- Advertisement -

এই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মসলাজাতীয় পণ্য পেঁয়াজের দাম; এই পণ্যটি কেজিতে ১৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। তবে গত এক বছরের ব্যবধানে সয়াবিন তেল ও ব্রয়লার মুরগির দাম ৭ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।

- Advertisement -google news follower

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এবার রোজায় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার শুল্ক কমানোসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে সেই সুবিধাগুলো ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁচ্ছাচ্ছে না।

তবে সরকার পাইকারি থেকে খুচরা বাজার পর্যায়ে তদারকিতে জোর দিলে সামনে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব দেখা যেতে পারে।

- Advertisement -islamibank

রোজার আগে বাজারে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে চাল, চিনি, তেল ও খেজুর আমদানিতে শুল্ক কমিয়েছে সরকার। গত ৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এসব পণ্যের শুল্ক কমানোর ঘোষণা দেয়। শুল্ক কমানোর এক মাস পার হয়ে গেলেও বাজারে এই চার পণ্যের মধ্যে দুটি পণ্যের দাম উল্টো বেড়ে বিক্রি হচ্ছে।

শুল্ক কমানোর পরও বাজারে খেজুর ও চিনির দাম নতুন করে বেড়েছে। খেজুর মানভেদে কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা এবং চিনি কেজিতে পাঁচ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে বিক্রি হচ্ছে। তবে ভোজ্য তেল সয়াবিন আমদানিতে শুল্ক কমানোর পর প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৭৩ থেকে কমিয়ে ১৬৩ টাকা করা হয়। যা গত ১ মার্চ থেকে কার্যকর হলেও বাজারে নতুন দরের তেল পাওয়া যাচ্ছে দুই-তিন দিন ধরে।

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিবছরই শুল্ক কমানোর সুবিধা আমদানিকারকা পেলেও ভোক্তাদের কাছে সেই সুবিধা পৌঁছায় না।

এবারও এর ব্যতিক্রম নয়
ভোক্তারা বলছেন, প্রতিবছরই নানা অজুহাত দিয়ে রোজার আগে আগেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। এবারও তাই হচ্ছে। এদিকে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলার সংকট এবং ঋণপত্র খোলা (এলসি) নিয়ে জটিলতার কারণে এবার পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়েছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা।

গতকাল নগরের পাহাড়তলী কাঁচাবাজারে কথা হয় ক্রেতা আফরোজা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর রোজার এক সপ্তাহ আগেই পুরো মাসের জন্য বাজার করা হয়। এবার বাজারে ইফতারের আইটেমসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেশি। যার কারণে প্রয়োজনমতো কিছুই কেনা যাচ্ছে না। আগে যেখানে দুই-তিন কেজি ছোলা কিনতাম এবার এক কেজি নিয়েছি। চিনি, ডাল, বেসন এগুলোও প্রয়োজনের চেয়ে কম কিনেছি এবার।’

তিনি বলেন, সরকার স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য টিসিবির মাধ্যমে কম মূল্যে পণ্য বিক্রি করছে। কিন্তু আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কিছু করার উচিত ছিল। কারণ আমাদের মতো নির্ধারিত আয়ের মধ্যবিত্তদের জন্য এই বাজারে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে গেছে। খাদ্যের তালিকটা কাটছাঁট করেও এখন চলা যাচ্ছে না।

একই বাজারের মুদি দোকানদার মিজান বলেন, ‘বাজারে পণ্যের দাম বেশি থাকায় ক্রেতারা এবার রোজার বাজার কমিয়ে কিনছেন। যাঁরা আগে একসঙ্গে দুই-তিন কেজি করে ছোলা, চিনি ও ডাল কিনতেন তাঁরাও এখন এক কেজির বেশি নিচ্ছেন না। যার কারণে বেচাকেনা কম এবার।’

জানতে চাইলে কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি নাজের হোসেন বলেন, ‘ডলারের সঙ্গে টাকার যে পরিবর্তন হয়েছে, এতে টাকার আমদানি ব্যয় বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবে আমদানি ব্যয় বাড়লে তার প্রভাব কিছুটা বাজারে পড়ে। এখন সবাই চেষ্টা করে তার যে ব্যয় বৃদ্ধি হলো, সেটি অন্যের ঘাড়ে কিভাবে চাপিয়ে দেওয়া যায়। ব্যয় বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ীরা এখন তাঁদের লাভের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে এবার বাজারে একটা নেতিবাচক প্রভাব আমরা দেখতেছি। সরকার অনেক উদ্যোগ নিয়েছে, তার সুফল এখন পর্যন্ত ভোক্তা পর্যায়ে তেমনভাবে পৌঁছায়নি।’

ক্রেতাদের হুমড়ি খেয়ে পণ্য না কেনার পরামর্শ দিয়ে নাজের হোসেন বলেন, ‘রমজানকে সামনে রেখে ক্রেতারা যদি হুমড়ি খেড়ে পণ্য না কিনে একটু সংযমী হয়ে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু কেনেন, তাহলে বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি পাবে না। আমরা আশা করছি, সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তার প্রভাবে বাজারে পণ্যের দাম কমবে। কারণ এবার বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে।’

২০২৩ সালের মার্চ মাসের বাজারদর এবং গতকাল বৃহস্পতিবার নগরের বিভিন্ন খুচরা বাজার এবং ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ছোলার দাম গত এক বছরের ব্যবধানে ১১ থেকে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়ে খুচরায় কেজি মানভেদে ১০০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি পেঁয়াজ কেজিতে ১৫৭ থেকে ১৭৫ শতাংশ দাম বেড়ে মানভেদে ৯০ থেকে ১১০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বাড়েনি।

বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৭ থেকে ১০ শতাংশ কমে ১৬৩ থেকে ১৭৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খোলা চিনি কেজিতে ২২ থেকে ২৫ শতাংশ দাম বেড়ে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছোট দানার মসুর ডাল কেজিতে ৭ থেকে ৮ শতাংশ দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায়। সাধারণ মানের খেজুর প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ দাম বেড়ে ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। তবে কিছুটা ভালোমানের খেজুর আজোয়া ও মরিয়ম মানভেদে কেজি ৮০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন সুপারশপে উন্নত মানের খেজুর তিন হাজার টাকা পর্যন্তও বিক্রি করতে দেখা গেছে।

জানতে চাইলে আমদানিকারক ও পাইকারি পাহাড়তলী পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘দেশের বাজারে পেঁয়াজের ঘাটতির কারণে এখন দাম বাড়তি। প্রতিবছরই বড় এই ঘাটতি আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয়। যখনই এসব পণ্যের আমদানি ব্যাহত হয়, তখনই দেশের বাজারে সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়ে দাম বেড়ে যায়। এবারও তাই হচ্ছে। বাজারে দাম কমাতে হলে পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে এবং সরবরাহ বাড়াতে হলে আমদানির বিকল্প নেই। সরকার ভারত থেকে ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু এখনো আমদানি শুরু হয়নি। যার কারণে বাজারে পেঁয়াজের দাম তেমনভাবে কমছে না।’

চিনির বাড়তি দামের বিষয়ে মেঘনা গ্রুপের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) তসলিম শাহরিয়ার বলেন, ‘বর্তমানে বিশ্ববাজারেই বাড়তি চিনির দাম। এখন একমাত্র ব্রাজিল থেকেই আমাদের চিনি আমদানি করতে হচ্ছে। একটি জাহাজ আসতেই দেড় থেকে দুই মাস সময় লেগে যাচ্ছে। এতে জাহাজ ভাড়া কয়েক গুণ বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নসহ বিভিন্ন কারণে এখন আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। চিনি আমদানিতে নামমাত্র শুল্ক কর কমানোর কারণে দেশের বাজারে চিনির দাম কমানো যাচ্ছে না।’

আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স এমএম এন্টারপ্রাইজের হাজী ইকবাল বলেন, সরকার নামমাত্র ডিউটি কমিয়েছে। আগে এক কনটেইনার ২৫ টন খেজুরে তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা ডিউটি ছিল। মাঝারি মানের খেজুর এক কনটেইনারে ডিউটি আসে ৬৪ লাখ টাকা। সেখান থেকে বর্তমানে সরকার মাত্র ১০ শতাংশ শুল্ক কমিয়েছে। এটাকে কমানো বলে না।’

এদিকে চাল আমদানিতে শুল্ক কমেছে প্রতি কেজিতে সাড়ে ২৩ টাকা। তবে আমদানি মূল্যের চেয়ে বাজারে চালের দাম কম থাকায় আমদানি করতে সাহস পাচ্ছে না আমদানিকারকরা। এই কারণেই চাল আমদানি বন্ধ রয়েছে।

জানতে চাইলে রাজধানীর চালের পাইকারি বড় বাজার পাহাড়তলী চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব ওসমান গণি বলেন, ‘নির্বাচনের পরপরই চালের বাজারে অস্থিরতা শুরু হলেও সরকারের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নিয়মিত বাজার অভিযানের কারণে এখন বাজার স্থির রয়েছে। পাইকারিতে কেজিতে দুই-তিন টাকা পর্যন্ত দামও কমেছে। বাজারে পর্যাপ্ত চালের মজুদ থাকায় রমজানে নতুন করে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই।’ আমদানিতে শুল্ক কমিয়েছে সরকার, কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশে চালের বাড়তির দামের কারণে এখন আমদানি হচ্ছে না বলেও তিনি জানান।

রমজানের আগে নতুন করে বাজারে বাড়ছে মাংসের দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে মুরগির দাম কেজিতে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে বিক্রি হচ্ছে। ব্রয়লার মুরগি কেজি ২১০ থেকে ২২০ টাকায় এবং সোনালি মুরগি কেজি মানভেদে ৩১০ থেকে ৩৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গরুর মাংস কেজি ৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে শবেবরাতের দিন নগরের বাজারে হঠাৎ দাম বেড়ে গরুর মাংস ৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছিল।

জানতে চাইলে কর্ণফুলী কিচেন মার্কেটের মেসার্স মা আয়েশা ব্রয়লার হাউসের ব্যবসায়ী মাহবুব হোসেন বলেন, ‘মুরগির বাজার এখন আগুন। এক সপ্তাহে কেজিতে ২০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে ব্রয়লার ও সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে। সামনে মুরগির বাজার যে কী হয়, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।’

জেএন/এমআর

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM