পোশাক রপ্তানির আড়ালে দুবাইয়ে ১৪৮ কোটি টাকা পাচার

তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচার করছে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। গত দুই বছরে এ ধরনের ১৪৮ কোটি টাকা পাচারের সত্যতা পেয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। অভিযোগ ১৯ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। সব অর্থই পাচার হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে এরই মধ্যে মামলার প্রস্তুতি নিয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

- Advertisement -

কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রামের ১৯ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে ১৪৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা পাচারের সত্যতা পায় কাস্টমস গোয়েন্দারা। এর মধ্যে ঢাকার ১৭টি এবং চট্টগ্রামের দুটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পাশাপাশি কাস্টমসের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টগুলো মুদ্রা পাচারের এসব কাজে সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। মুদ্রা পাচারে জড়িত ১৯ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে টোটাল কোয়ালিটি কোম্পানি ১৯টি চালানের মাধ্যমে ২৫৬ টন ২শ কেজি পণ্য রপ্তানি করে। এসব পণ্যের মূল্য দেখানো হয় এক লাখ ১৫ হাজার ৭শ ডলার। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এসব পণ্যের মূল্য সাত লাখ ৬৮ হাজার ৬শ ডলার বলে জানতে পারেন কাস্টমস গোয়েন্দারা।

- Advertisement -google news follower

একইভাবে তাবাসসুম ইন্টারন্যাশনাল নামের প্রতিষ্ঠানটি ছয়টি চালানের মাধ্যমে ৪০ টন ৬১৭ কেজি পণ্য রপ্তানি করে। এসব পণ্যের রপ্তানিমূল্য ৬৬ হাজার ৬০১ ডলার দেখানো হলেও প্রকৃত রপ্তানি মূল্য এক লাখ ২১ হাজার ৮৫১ ডলার। সেফ ফ্যাশন অ্যান্ড ট্রেডিং নামে প্রতিষ্ঠানটি ৫০টি চালানে ৬৭২ টন ৫৩৮ কেজি পণ্য রপ্তানি করে। এসব পণ্যের রপ্তানিমূল্য দেখানো হয় ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৭৪৩ ডলার। প্রকৃতপক্ষে এসব পণ্যের রপ্তানিমূল্য ছিল ২০ লাখ ১৭ হাজার ৬১৪ ডলার।

জোবায়ের ট্রেডিং নামে প্রতিষ্ঠানটি ১১ চালানের বিপরীতে ১৫০ টন ১শ কেজি পণ্য রপ্তানি করে। এসব পণ্যের রপ্তানিমূল্য ৬৮ হাজার ৬৪১ ডলার দেখানো হলেও সত্যিকার রপ্তানিমূল্য ছিল ৪ লাখ ৫০ হাজার ৩শ ডলার। মেঘনা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে প্রতিষ্ঠানটি ১৩ চালানে ১৬৪ টন ৯শ কেজি পণ্য রপ্তানি করে। তারা এসব পণ্যের রপ্তানিমূল্য দেখায় দুই লাখ ৫০ হাজার ২৫৮ ডলার। কিন্তু কাস্টমস গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে চার লাখ ৯৪ হাজার ৭শ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে প্রতিষ্ঠানটি।

- Advertisement -islamibank

এম আই ট্রেডিং নামে প্রতিষ্ঠানটি ৯ চালানে ১২৫ টন ২শ কেজি পণ্য রপ্তানি করে। প্রতিষ্ঠানটি এসব পণ্যের রপ্তানিমূল্য প্রদর্শন করে ৫৯ হাজার ৬৯৭ ডলার। কিন্তু প্রকৃত রপ্তানিমূল্য হবে তিন লাখ ৭৫ হাজার ৬শ ডলার। মারওয়া ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে প্রতিষ্ঠানটি ১৪ চালানে ১২৫ টন ৫৪৯ কেজি পণ্য রপ্তানি করে। প্রতিষ্ঠানটি এসব পণ্যের রপ্তানি মূল্য দেখিয়েছে তিন লাখ ২২ হাজার ৩২৫ ডলার। কিন্তু প্রকৃতি রপ্তানিমূল্য হবে তিন লাখ ৭৬ হাজার ৬৪৭ ডলার।

কে মুড টেক্সটাইল নামে প্রতিষ্ঠানটি ৩১ চালানে ৩৯১ টন ২৮৮ কেজি পণ্য রপ্তানি করে দুই লাখ ২৫ হাজার ৭৭০ ডলার রপ্তানিমূল্য দেখায়। কিন্তু এসব পণ্যের প্রকৃত রপ্তানিমূল্য ১১ লাখ ৭৩ হাজার ৮৬৪ ডলার। নাজাফ ট্রেডিং ১৯ চালানে ২৫৪ টন ৫শ কেজি পণ্য রপ্তানি করে। তারা এসব পণ্যের রপ্তানিমূল্য এক লাখ ৯ হাজার ৫০১ ডলার দেখালেও প্রকৃত রপ্তানিমূল্য হচ্ছে ৭ লাখ ৬৩ হাজার ৫শ ডলার। তাহসিন ইন্টারন্যাশনাল ১৮ চালানে ২৪৬ টন ২শ কেজি পণ্য রপ্তানি করে এক লাখ ১৬ হাজার ৭৪৯ ডলার রপ্তানিমূল্য হিসেবে দেখায়। কিন্তু রপ্তানি করা পণ্যের প্রকৃত মূল্য ৭ লাখ ৩৮ হাজার ৬শ ডলার হওয়ার কথা।

আল ফাহাদ ট্রেড লাইন্স চার চালানে ৫২ টন ৯৫০ কেজি পণ্য রপ্তানি করে ৩৫ হাজার ৮২৫ ডলার প্রদর্শন করে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানি করা পণ্যের প্রকৃত মূল্য এক লাখ ৫৮ হাজার ৮৫০ ডলার। এয়ার বাংলা নামে প্রতিষ্ঠানটি ২৫ চালানে ১৯২ টন ৩৮২ কেজি পণ্য রপ্তানি করে। এসব পণ্যের রপ্তানিমূল্য ৯৭ হাজার ৬৬৩ ডলার দেখানো হলেও প্রকৃত মূল্য হচ্ছে পাঁচ লাখ ৭৭ হাজার ১৪৬ ডলার। জিএস খান অ্যাপারেলস ২২ চালানে ২৯৭ টন ৫২ কেজি পণ্য রপ্তানি করে। তারা এক লাখ ৮০ হাজার ২৯১ ডলার পণ্য মূল্য হিসেবে দেখালেও রপ্তানিপণ্যের আসল মূল্য আট লাখ ৯১ হাজার ১৫৬ ডলার।

ইমাজিন ফ্যাশন লিমিটেড আট চালানে ১০৭ টন ২শ কেজি পণ্য রপ্তানি করে। তারা এসব পণ্যের রপ্তানিমূল্য দেখায় ৪৮ হাজার ডলার। কিন্তু প্রকৃত রপ্তানিমূল্য হচ্ছে তিন লাখ ২১ হাজার ৬শ ডলার। মাস্টার ইন্টারন্যাশনাল সাত চালানে ৮০ টন ৩৫ কেজি পণ্য রপ্তানি করে। তারা রপ্তানিপণ্যের মূল্য দেখায় ৫৫ হাজার ডলার। কিন্তু রপ্তানিপণ্যের আসল মূল্য দুই লাখ ৪০ হাজার ১০৫ ডলার। ফ্যাশন কমফোর্ট (বিডি) লিমিটেড ২৩ চালানে ৩১৩ টন ৯শ কেজি পণ্য রপ্তানি করে। তারা এসব পণ্যের রপ্তানিমূল্য এক লাখ ৭৮ হাজার ৬৮৫ ডলার দেখালেও প্রকৃত রপ্তানিমূল্য হচ্ছে ৯ লাখ ৪১ হাজার ৭শ ডলার।

এ আইফা এন্টারপ্রাইজ ৩৯ চালানে এক হাজার ১৩৪ টন ২১৭ কেজি পণ্য রপ্তানি করে। তারা রপ্তানিপণ্যের মূল্য দেখায় ৫ লাখ ৩৬ হাজার ১৯৪ ডলার। প্রকৃত অর্থে প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানিপণ্যের মূল্য ৩৪ লাখ ২ হাজার ৬৫১ টাকা।

ফাস্ট এক্সপোর্টস (বিডি) লিমিটেড ৪৬ চালানে ৫৮২ টন ৩৩০ কেজি পণ্য রপ্তানি করে। প্রতিষ্ঠানটি রপ্তানিপণ্যের মূল্য দুই লাখ ৫৫ হাজার ৪০৫ ডলার দেখালেও রপ্তানিপণ্যের প্রকৃত মূল্য ছিল ১৭ লাখ ৪৬ হাজার ৯৯০ ডলার এবং জেডইই ফ্যাশন নামে প্রতিষ্ঠানটি ৬০ চালানে ৫৬৯ টন ৬০৪ কেজি পণ্য রপ্তানি করে। তারা রপ্তানিপণ্যের মূল্য এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৮ ডলার প্রদর্শন করলেও রপ্তানিপণ্যের প্রকৃত মূল্য ছিল ১৭ লাখ ৮ হাজার ৮১২ ডলার।

সবমিলিয়ে ১৯ প্রতিষ্ঠান ৪২৪ চালানে পাঁচ হাজার ৭৫৬ টন ৭৬২ টন পণ্য রপ্তানি করে। এসব পণ্যের রপ্তানিমূল্য দেখানো হয় ৩৪ লাখ ১৩ হাজার ১১৬ ডলার। কিন্তু এসব পণ্যের প্রকৃত রপ্তানিমূল্য এক কোটি ৭২ লাখ ৭০ হাজার ২৮৬ ডলার। এসব প্রতিষ্ঠান পণ্য রপ্তানির আড়ালে বাকি এক কোটি ৩৮ লাখ ৫৭ হাজার ১৭০ ডলার পাচার করেছে বলে জানতে পারে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। যা বাংলাদেশি টাকায় ১৪৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।

কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বশির আহমেদ বলেন, ঢাকার ১৭ এবং চট্টগ্রামের দুই প্রতিষ্ঠান দুবাইয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে ১৪৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা পাচার করেছে বলে প্রমাণ মিলেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো রপ্তানিপণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে দুবাইয়ে পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মাধ্যমে প্রদর্শিত মূল্যের টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে এলেও বাকি টাকা দুবাইয়ে রেখে দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই ১৯ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মুদ্রাপাচারের ফৌজদারি আইনে শিগগির মামলা দায়ের করা হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, মূলত দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর দুবাইয়ে নিজেদের এজেন্ট থাকে। এজেন্টরা নিজেরাই প্রতিষ্ঠান খুলে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে। এখানে বেশিরভাগ সময় আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক একই ব্যক্তি বা সিন্ডিকেটের প্রতিষ্ঠান। তারা নিজেদের টাকা কিংবা তৃতীয়পক্ষের কারো টাকা পণ্য রপ্তানির আড়ালে বিদেশে পাচার করেছে। এখন অধিকতর তদন্তে বিষয়গুলো উদঘাটন করা সম্ভব।

শুধু রপ্তানিকারক নয়, এর মধ্যে ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান, সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান এবং কাস্টমসের লোকজনও জড়িত থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

জেএন/এমআর

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM