মালিকানা বদল হচ্ছে বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের!

অনলাইন ডেস্ক

রাজধানীর মুগদায় গ্রিন মডেল টাউনে অবস্থিত বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় জামায়াত ঘরানার লোকজন দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে বলে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে উঠে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দলের মতাদর্শ প্রচার ছাড়াও নানা আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পেলে দ্রুত সময়ের মধ্যে বদলে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়টির মালিকানা। এই মুহূর্তে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে রয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিআইইউ) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা।

- Advertisement -

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

- Advertisement -google news follower

সূত্রে জানা যায়, গতকাল মঙ্গলবার বিআইইউ’র সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে বসেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের নানা অনিয়ম, শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ প্রচারসহ বিভিন্ন দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়। এছাড়া ইউজিসির সর্বশেষ করা একটি তদন্ত প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ মন্ত্রীকে দেখানো হয়। সবকিছু দেখে সেখানে উপস্থিত গোয়েন্দা সংস্থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি প্রতিবেদন আকারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন মন্ত্রী।

বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) ড. ফরহাদ হোসেন বলেন, বৈঠকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক চিত্র মন্ত্রীর সামনে তুলে ধরা হয়। পরে মন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক চিত্র প্রতিবেদন আকারে জমা দেওয়ার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছেন।

- Advertisement -islamibank

বুধবার (৮ মে) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সেখানে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশের বিশেষ শাখাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নানা তথ্য, ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনসহ একটি রেজ্যুলেশন তৈরি করে পাঠানো হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে গোয়েন্দা সংস্থাকে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে চিঠিতে বলা হয়েছে।

যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

২০০৫ সালে রাজধানীর গোপীবাগে বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন জামায়াত ঘরানার কিছু লোক। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাম লেখা হয় অধ্যাপক কামাল উদ্দীন আবদুল্লাহ জাফরীর, তিনি একইসঙ্গে এটির ট্রাস্টি বোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যানও হন। তিনি যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত প্রয়াত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বেয়াই। এরপর থেকে জামায়াত-শিবির ঘরানার লোকজন দিয়ে পরিচালিত হয়ে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।

২০১৯ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরপর চাকরিচ্যুত শিক্ষকরা বিষয়টি বেআইনি দাবি করে ইউজিসিতে অভিযোগ করেন। এরই প্রেক্ষিতে ইউজিসি সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) বিশ্বজিৎ চন্দকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিবেদন দাখিল করে।

ইউজিসির তদন্তে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসে। তদন্ত কমিটি ট্রাস্টি বোর্ডের কোটি কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পায়। ইউজিসি ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে দেওয়াসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের সুপারিশ করে। একই সঙ্গে বোর্ড সদস্যদের হাতিয়ে নেওয়া অর্থ আদায়, দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে তদন্তসহ নয় দফা সুপারিশ করে।

ট্রাস্টি বোর্ডের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত ১০ শিক্ষককে অবৈধভাবে চাকরিচ্যুতির প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করায় শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার অজুহাতে তাদের (শিক্ষকদের) চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।

ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিব মিলে গত ১১ বছরে মাসিক সম্মানী বাবদ ছয় কোটি ১৩ লাখ ৩২ হাজার টাকা নিয়েছেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান কামাল উদ্দীন জাফরী বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে ১১ বছরে মাসিক সম্মানী ও গাড়ি সুবিধা বাবদ তিন কোটি ৬৬ লাখ ছয় হাজার টাকা নিয়েছেন। ভাইস চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আ ন ম রফিকুর রহমান এক কোটি ৩৩ লাখ ১৬ হাজার, সদস্য সচিব সৈয়দ শহীদুল বারী এক কোটি ১৪ লাখ নয় হাজার ৯৪০ টাকা নিয়েছেন।

অথচ ট্রাস্টি বোর্ডের ডিডে (দলিল) উল্লেখ করা হয়েছিল— এ ট্রাস্ট জনহিতকর, অলাভজনক ও অবাণিজ্যিকভাবে ইসলামি আদর্শে পরিচালিত হবে। কিন্তু বোর্ডের কয়েকজন সদস্য এটাকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। সম্মানী ছাড়াও সিটিং অ্যালাউন্সবাবদ কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তারা। (অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় চারজন সদস্য মাত্র এক কোটি ৫৬ লাখ ২৯ হাজার ৮৫৬ টাকা বিনিয়োগ করেন)।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী হাতিয়ে নেওয়া এসব অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি এসব অনিয়ম বিশদভাবে খতিয়ে দেখতে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলার সুপারিশ করা হয়েছে।

ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অনুমতির মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী নবায়নের জন্য তারা আবেদন করেনি। পাঁচ কোটি টাকা ব্যাংকে এফডিআর জমা রাখা বাধ্যতামূলক থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের এফডিআরের সুদ ও আসল উত্তোলন করা হয়েছে। সাধারণ তহবিল ও আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনা করা হয়নি। স্থায়ী ক্যাম্পাসের জমি কেনা ও ভবন নির্মাণের জন্য ১০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেওয়া হলেও জমি কেনা হয়েছে তিন কোটি টাকায়। প্রত্যেক অর্থবছরে নিরীক্ষার (অডিট) বিধান থাকলেও ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পর আর্থিক নিরীক্ষা করা হয়নি। গ্রিন মডেল টাউনে স্থায়ী ক্যাম্পাসে ভবন নির্মাণের জন্য রাজউকের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে বোর্ড চেয়ারম্যানের আত্মীয়কে দিয়ে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণ কাজে ব্যাপক আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।

কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকায় প্রতিবেদনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনেরও সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি।

ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ

ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বোর্ড সদস্যদের অদূরদর্শি ও অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি আর্থিকভাবে জটিল দৈন্যদশায় পড়েছে। তাদের খেয়ালখুশি মতো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির চলমান অচলাবস্থা নিরসনে চ্যান্সেলরের এখতিয়ার প্রয়োগ করে জরুরি ভিত্তিতে বোর্ড পুনর্গঠনের সুপারিশ করেছে ইউজিসি।

এ প্রসঙ্গে ইউজিসি সদস্য বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ এর ৩৫ (৭) ধারা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টি পুনর্গঠনের সুপারিশ করেছি। এখানে কারা আসবেন, কারা বাদ পড়বেন‌ সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।

মঙ্গলবার (৭ মে) অনুষ্ঠিত শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত একজন কর্মকর্তা বলেন, সরাসরি ট্রাস্টি বোর্ড না ভেঙে বিকল্প পদ্ধতিতে ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের পক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতির কাছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে মতামত চাওয়া হবে। সেজন্য গোয়েন্দা সংস্থার মতামত ও সুপারিশ চাওয়া হয়েছে।

বোর্ড অব ট্রাস্টি পরিবর্তনের বিষয়ে আইনে কী বলা আছে

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ এর ৩৫ (৭) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো কারণে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা দেখা দিলে কিংবা উহার স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত ও শিক্ষার্থীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে, উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখিবার স্বার্থে চ্যান্সেলর কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশক্রমে প্রয়োজনীয় আদেশ ও নির্দেশ দিতে পারিবেন এবং চ্যান্সেলরের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গণ্য হইবে।’

প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টি পুনর্গঠন করে দেয় সরকার। নর্থ সাউথের আগের ট্রাস্টিদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ আমলে নিয়ে ইউজিসির সুপারিশের আলোকে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে তা সম্পন্ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই বছর ৮ সেপ্টেম্বর মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড পরিবর্তন করা হয়। এবার একই আইনে বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ড পরিবর্তন করতে যাচ্ছে সরকার।

জেএন/এমআর

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM