আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি

আকাশ-বাতাসে শরত। মণ্ডপে মণ্ডেপে আগমনীর সুর। বাঙালি হিন্দুর বারো মাসের তেরো পার্বণের অন্যতম দুর্গা পুজো সমাগতপ্রায়। দিন ফুরালেই মহালয়া। রেডিওতে বাজবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের অমর ভাষ্য মহিষাসুরমর্দিনী গাঁথা। মহালয়ার আগমনীতে অকৃত্রিম মাতৃবন্দনা ও  হিন্দু মিথোলজির সাথে ইতিহাস প্রসঙ্গে জয়নিউজের জন্য কয়েকছত্র লিখলেন পশ্চিমবঙ্গের কবি ও সংস্কৃতিকর্মী অরিত্রা মুখোপাধ্যায়

মহালয়ার আগের দিন রাত থেকেই চারিদিকে ‘মহালয়া’ ‘শোনা’র রব ওঠে, ট্রেন-বাস-অটো-টোটোতে শুনলুম নাকি ‘মহালয়া’ এপ ও বহুল ভাবে প্রচলিত। ’মুখের পুস্তক’ যদিও রেডিওতে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠকে ভোরের আলো ফোটার আগেই তোমার আমার ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করার দায়িত্ব পালন করেছে, তবু দিনের দিন ওই বিশেষ কন্ঠ শ্রবণের অনুভূতির বিকল্প নেই। আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে এই অনুভূতি, তবে বাঙালি হিসেবে আগে কিছু ধারণা পরিষ্কার করে তার পর সংস্কৃতির বাহক হওয়া উচিত নয় কি?

- Advertisement -

আজকাল তো ‘বাঙালি’ বিলুপ্ত হয়ে আসছে, বাংলা পড়তে না জানাটাও নাকি শিক্ষার অঙ্গ! তা একে বিলিতি কালচারের ভালচার বানানোর ছুতো বলুন, বা “BONG” সাজার গুঁতো বলুন … সবই এক। বলি কি একটু এক চালায় ফিরুন না একটা দিন, সাবেকিয়ানা না হয় রইল ভাব-ভাবনায় মিলে মিশে। ‘মহালয়া’ থেকে দেবীপক্ষের শুভারম্ভ হয় , পূর্ব পুরুষের আত্মার শান্তি কামনায় তর্পণ করেন বাবা-জ্যেঠুরা। ব্যাস! এটুকুই? তবে কী আক্ষরিক অর্থ বলে কিছুই নেই? নিশ্চই আছে। ধর্ম অনর্থক নয় ,তাই আচার-আচরণও গূঢ় অর্থ বহন করে।

- Advertisement -google news follower

‘হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করতে পারেন। এই পিতৃলোক হল এককথায় ‘যমপুরী’। পিতৃলোক শাসন করেন স্বয়ং ‘মৃত্যুদেবতা’ যম। মানুষের মৃত্যুর পর তার আত্মাকে মর্ত্যলোক থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান যমরাজ। এবং সেখানেই তাদের বাস করতে হয় ততদিন, যতদিন না পরবর্তী প্রজন্মের কারও মৃত্যু হচ্ছে। পরবর্তী প্রজন্মের কারোর মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের অগ্রগণ্য পিতৃলোক ছেড়ে যাত্রা করেন অমর্ত্যলোকে। সেখানে মিলিত হন এবং লীন হয়ে যান ঈশ্বরের সাথে। এই ভাবে তিনি সমস্ত শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের অতীত হয়ে ওঠেন। প্রয়াতর আত্মার সমাবেশস্হলকেই ‘মহালয়’ বলে চিহ্নিত করা হয়। আর এই ‘মহালয়’ থেকে ‘মহালয়া’ শব্দের উৎপত্তি। পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণাদির মাধ্যমে প্রয়াতর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার জন্যই এমন দিনটিকে ‘মহালয়া’ নামে অভিহিত করা হয়। ভোর বেলা রেডিও তে “মহিষাসুরমরদ্দিনী” অনুষ্ঠানে, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র মহাশয়ের কণ্ঠে ‘চণ্ডীপাঠ’ শোনাটা আমাদের উপরি পাওনা, এবং আমরা এই উপরিতেই সমৃদ্ধ… তাই ব্যাপারটা এই রকম দাঁড়াচ্ছে যে শুনি আমরা ‘মহিসাসুরমরদ্দিনী’ আর দিনটা হ’ল ‘মহালয়া’। ‘মহালয়া’ শোনা হয় না।

আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি | maha 759

- Advertisement -islamibank

পুজোর আর বাকি হাতে গুনে কটা মাত্র দিন । তাই আজ এমন কিছু লিখছি যেটা এই পুজো পুজো গন্ধটাকে আরও নিজের করে অনুভব করায় আমাকে। চিরকাল বাঙালী যুগের হুজুগে গা ভাসাতে ভালোবাসে, অবশ্য ক্ষেত্র বিশেষে এটা পরিবর্ধনশীল- পরিবর্তনশীল। তবে লুচি-বেগুনভাজা বা গরম রসগোল্লার মতো কিছু চিরস্থায়ী ভালোবাসা রয়েই গেছে ‘সভ্যতার সেই আদিম যুগ থেকে’ । এই রকমই একটা আদ্য প্রান্ত বাঙালিয়ানার ঐতিহ্য রসে ডুবে থাকা উৎসব ‘দুগ্গা পুজো’ মানে দুর্গোৎসব। তা মা-এর বোধন থেকে বিসর্জন তো সকলেরই জানা, তাই কাসুন্দি ঘাঁটার ভারটা লাঘব করে একটু নতুন কথা বলবো। পাঠক ভাববেন ‘মা দুগ্গা তো সেই চিরকালের আপন জন, তাকে নিয়ে আবার নতুন কথা তুমি কি বানাবে হে?’ … না নতুন নয় সময়ের চাকা টা পিছিয়ে দিয়ে একটু প্রাচীন কথা ভাগ করে নেওয়াই আমার এই লেখার মূল উদ্দেশ্য।

সময়টা তুর্কী আক্রমণের, তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বখতিয়ার খিলজি ১২০৫ (মতান্তরে ১২০৬, কেউ বলেন ৭) সালের দিকে তৎকালীন বঙ্গের শাসক সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মন সেনকে পরাজিত করে ‘গৌড়’ দখল করেন। ভয়াবহতার কাল, অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধে লিপ্ত বাঙালি তার আদর্শ ‘নায়ক’ চরিত্রের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে, জাতিকে সাহস প্রদান করতে অনুবাদ করে চলেছে একাধিক সংস্কৃত কাহিনী, রামায়ন ,মহাভারত, ভাগবত সহ আরও আরও অনেক পৌরাণিক উপাখ্যান যা শক্তি যোগানোর রসদ। এমন সময় ‘মহাভারত’এ তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের কিছু শ্লোকের (‘মহাভারত’, ভীষ্ম পর্ব) অনুবাদ এবং ‘রামায়ন’এ শ্রী রাম চন্দ্রের যুদ্ধ জয়ের হেতু ‘অকাল বোধন’ এর উপাখ্যান থেকে উঠে এলো দেবী শক্তির কাহিনী, বাংলা সাহিত্য জগতে প্রারম্ভ হলো এক নতুন অধ্যায়ের। পূর্বে দেব নাগরী ভাষায় জ্ঞানী মানুষই (বিশেষত ব্রাহ্মণ) কেবল দেবী দুর্গার কথা জানতেন, যিনি দুর্গের রক্ষা করেন, আবার কেউ বলেন ‘দুর্গ’ অসুর কে বধ করে এই নাম হয়েছে দেবীর। বাঙালী এত শত তত্ব ও তথ্যের টানাপোড়েন পেরিয়ে উঠতে পারবে কি না সেই অনিশ্চয়তার খাতিরে আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদ এর সূচনা হয়। আবার কবির লেখনী যাতে সর্ব জন বোধ্য হয় তার জন্য অচিরেই মা দুর্গা রূপ পেলেন শিব পত্নীর, যিনি দরিদ্রের ঘরণী , স্বামীর সাথে নিত্য ঝগড়া তার , আরও অনেক সাধারণ মানুষের গুণ ও জীবন যাপন পদ্ধতি আরোপিত এই সব কাহিনীতে। সেটা ‘মঙ্গল কাব্য’এর যুগ।

আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি | travelers diary get prepared to head east for the awaited durga pujaআশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি | Durga Puja ss 513470017 790x400

ক্রমশ সাহিত্যের গ্রহণ যোগ্যতা বাড়তে থাকলো, চিরাচরিত এক বাঙালি মেয়ের বছরে একবার সন্তান সহ বাপের বাড়ি আসার গপ্পো হয়ে উঠলো একটা সমগ্র পদাবলী- ‘শাক্ত পদাবলী’ । এর পংক্তি গুলো শুধু কাব্য নয় ‘গান’ হয়ে পৌঁছে গেলো প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার আলো ছড়িয়ে দিতে অক্ষম। এ যেন এক অতি সাধারণ সংসারের গাথা, গিরিরাজ , মেনকা, উমা, শিব এরা দেবতা কম, রক্ত মাংসের চরিত্র হয়ে উঠলো শ্রোতার অনুভবে। আমরা খুব কমই চেষ্টা করি নিজেদের অতীতটাকে খুঁড়তে, যদিও এত সমৃদ্ধ সাহিত্যিক অতীত খুব কম ভাষার বরাতে দেখা যায়। আমাদের মায়ের ভাষার ‘অনুবাদ সাহিত্য’ পড়লে জানতে পারি অষ্টশক্তি অর্থাৎ ব্রহ্মাণী, মাহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, ঐন্দ্রী, যজ্ঞবরাহী, নারসিংহী ও চন্ডিকার কথা।

নবদুর্গা অর্থাৎ শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্ডঘন্টা, কুষ্মাণ্ডা , স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী, সিদ্ধিদাত্রীর প্রসঙ্গ। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র মহাশয়ের সেই অপূর্ব কন্ঠ প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে বাঙালীর উৎসবের সূচক, মা কে আবাহন করতে শ্রী শ্রী চন্ডী পাঠ অপরিহার্য হলেও তার ভেতরের কথায় আমাদের উৎসাহ নেই। এটাও তো সাহিত্যের অঙ্গ, নয় কি? মায়ের মৃন্ময়ী রূপের আজ চোখ আঁকছেন আজ লক্ষ লক্ষ শিল্পী, কেনাকাটিতেও ছাড়ের মরসুম চলছে , সব মিলিয়ে বেশ একটা পুজো পুজো আমেজ বুঝিয়ে দিচ্ছে ‘হে বঙ্গবাসী তোমাদের শ্রেষ্ঠ উৎসব এই এসে হাজির হলো বলে,প্রস্তুত হও’ । চলুন না এবার একটু ‘bong’ থেকে বাঙালী হওয়া যাক, এমন দিন গুলোয় মা দুগ্গার আসার সাথে সাথে আমাদের মায়ের-ভাষার ইতিহাস টাও একটু উল্টে পাল্টে দেখি।

অরিত্রা মুখোপাধ্যায়: পশ্চিমবঙ্গের কবি, সংস্কৃতি ও সাহিত্যকর্মী।

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM