সংকট নেই তবুও দামে ফারাক,চালবাজি বন্ধে নজরদারির তাগিদ

0

দেশে এখনো ৬ মাসের সংকট মোকাবিলা করার মতো সরকারি গুদামে ১৭ লাখ টনের বেশি চালের মজুত রয়েছে। পর্যাপ্ত ধান-চাল রয়েছে কৃষকের গোলা, চাতাল ও রাইস মিলের গুদামে।

অন্যদিকে আমন ধান ঘরে তোলার সময়ও আসন্ন। ফলে বিশ্ববাজারে চালের দাম বাড়ার প্রভাব দেশের বাজারে পড়ার কোনো শঙ্কা নেই। তবে চালের দাম স্বাভাবিক রাখতে বাজারে তদারকি বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা।

তাদের আশঙ্কা, গত সপ্তাহে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পরপরই দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট যেভাবে এর দাম কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা বাড়িয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে ভারতের সেদ্ধ চাল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের সুযোগ নিয়ে চাল সিন্ডিকেট বাজার অস্থিতিশীল করে তুলবে। তাই তাদের অপতৎপরতা রুখতে সরকারের আগাম সতর্কতা জরুরি।

পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, দেশে চালের বার্ষিক চাহিদা ৩ কোটি ৫৬ লাখ টন। আর কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চাল উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৮৩ লাখ টন। সুতরাং দেশে এই মুহূর্তে চাহিদার চেয়েও বেশি চাল রয়েছে।

বর্তমানে সরকারি গুদামে প্রায় ২০ লাখ টন খাদ্য মজুত রয়েছে, এর মধ্যে চালই রয়েছে ১৭ লাখ টনের বেশি। দেশে পর্যাপ্ত চাল থাকায় আমদানিও কমানো হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে ৮ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়।

তবে উৎপাদন ভালো হওয়ায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে মাত্র ২ লাখ টন করা হয়েছে। তাছাড়া দেশে পর্যাপ্ত উচ্চমূল্যে স্থিতিশীল রয়েছে অভ্যন্তরীণ চালের বাজার।

অন্যদিকে খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেছেন, ‘ভারত থেকে এ বছর চাল আমদানির কোনো পরিকল্পনা নেই, তাই দেশে কোনো প্রভাব পড়বে না। দেশেই এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে এবং সরকারি গুদামে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে।

তাই চালের বাজারে এখন কোনো সংকট হবে না। ভারতের সেদ্ধ চাল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তে দেশের চালের বাজারে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা নেই।’

তবে দেশে পণ্যের ঘাটতি না থাকলেও ভারতের বাজারের নেতিবাচক প্রভাবের সুযোগ নিয়ে দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট যাতে দেশীয় বাজার অস্থিতিশীল করে তুলতে না পারে এজন্য সব জেলা প্রশাসককে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে সতর্ক বার্তা দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সে সঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকেও বিষয়টি মনিটরিং করা হবে।

তবে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মনে করেন, চালের বাজারে আরও কঠোর নজরদারি জরুরি। তিনি বলেন, ভারত সরকার পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার পরপরই দেশেও পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। এভাবে আরও অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেও বাজার সিন্ডিকেট এ ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

ব্যবসায়ীদের অসাধুতা দেশের মানুষ বিভিন্ন সময় দেখেছে। এবার চালের ক্ষেত্রেও যে এমনটি হবে না- সে নিশ্চয়তা কে দেবে। একমাত্র সরকারই পারে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে। দেশে যেহেতু চালের কোনো সংকট নেই, তাই ভারতের চাল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্তে দেশের বাজারে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই।

তবুও অসাধু ব্যবসায়ীরা বা সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা যাতে এই সুযোগে চালের বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারে সে বিষয়ে সরকারকে চালের বাজারকে কঠোর মনিটরিংয়ে রাখা জরুরি।

তবে বাজার পর্যবেক্ষকরা অনেকে মনে করেন, সরকারের গুদামে যে পরিমাণ চাল মজুত রয়েছে, তাতে বাজার সিন্ডিকেট দাম বাড়ানোর অপতৎপরতা চালালে সে মিশন ব্যর্থ হবে। কেননা পর্যাপ্ত মজুত থাকার কারণে সরকার বাজারে সরবরাহ বাড়িয়ে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবে।

এ প্রসঙ্গে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমন ও বোরোর ফলন ভালো হয়েছে। খাদ্যশস্য সংগ্রহও এখন পর্যন্ত ভালো। তাই মধ্যস্বত্বভোগীদের বাজার কারসাজির সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো (বিবিএস) ২০২২-২৩ অর্থবছরের বোরো উৎপাদনের প্রাক্কলন এখনো প্রকাশ করেনি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) বোরো মৌসুমের ধানের হিসাব ধরলে চলতি বছরে মোট উৎপাদন ৫ শতাংশ বেড়ে ৪ কোটি টন হতে পারে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুসারে, এবার বোরোর ফলন হয়েছে ২ কোটি ১৮ লাখ টন, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি। খাদ্য অধিদপ্তর মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে কৃষকদের কাছ থেকে বোরো ধান ও চাল কেনা শুরু করে।

এ পর্যন্ত স্থানীয় বাজারগুলো থেকে ১০ লাখ ১৩ হাজার টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। খাদ্য অধিদপ্তর ১৫ লাখ ১০ হাজার টন খাদ্যশস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আগস্ট পর্যন্ত শস্য কেনা অব্যাহত রাখবে।

অন্যদিকে গেস্নাবাল ফুড আউটলুক প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়েছে, এক বছরে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হারে চালের উৎপাদন বাড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশে। বিদায়ী বছরের (২০২২-২৩) চেয়ে নতুন বছরে (২০২৩-২৪) উৎপাদন বাড়তে পারে ১ দশমিক ৮ শতাংশ। আর মোট চালের উৎপাদনে চীন ও ভারতের পর তৃতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।

বিদায়ী বছরে বাংলাদেশে উৎপাদন ৩ কোটি ৮৩ লাখ টন। আগামী বছরে উৎপাদন দাঁড়াতে পারে ৩ কোটি ৮৯ লাখ টনে। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে প্রকাশ করা গেস্নাবাল ফুড আউটলুক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

তবে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধানের বাম্পার ফলন হলেও দেশের ভোক্তার খুব একটা উপকারে আসেনি। কারণ বাজারে চালের দাম তেমন একটি কমেনি। তবে নতুন করে চালের দাম আর না বাড়লেও দেশের চালের বাজার এখন উচ্চমূল্যে যেভাবে স্থিতিশীল রয়েছে তা অনেকটা সহনীয়। সিন্ডিকেটের কারসাজিতে এর দাম আরও বাড়লে নিম্ন মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস উঠবে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সামগ্রিক উৎপাদনের তুলনায় চালের ওপর বাংলাদেশের আমদানি নির্ভরতা কম। ভারতের চাল রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ দেশের চালের বাজারে প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। কেননা সরকারি খাদ্য মজুতের দিক থেকে দেশ ভালো অবস্থানে আছে।

আগামী ৩ মাসের মধ্যে আরও একটি ফসল পাওয়া যাবে। তবে সরকারের উচিত নিবিড়ভাবে বাজার পর্যবেক্ষণ করা, যাতে বাজার সংশ্লিষ্টরা দাম বাড়ানোর চেষ্টা করলে ব্যবস্থা নিতে পারে।’

এদিকে ভারত চালের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের নেতিবাচক প্রভাব দেশের বাজারে পড়তে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা জোরালো আশঙ্কা প্রকাশ করে এ ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।

বিশেষ করে বাজার সিন্ডিকেট যাতে কোনো কারসাজি করতে না পারে এজন্য মনিটরিং বাড়ানোর উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলছেন, ভারত তাদের নির্বাচনকে সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে গিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারকে অস্থির করে দিচ্ছে, যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে। ভারতের সিদ্ধান্তকে অজুহাত হিসেবে নিয়ে বাংলাদেশে যারা এসব পণ্যের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে তারা সুযোগ নেবে।

যদিও দেশের চাল আমদানিকারকরা এ আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের ভাষ্য, চাল নিয়ে ভারতীয় সিদ্ধান্তের কোনো নেতিবাচক প্রভাব এখনই পড়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ ছয় মাস আগে যে পরিমাণ চাল আমদানি করা হয়েছে তারই একটি বড় অংশ এখনো অবিক্রীত রয়েছে।

তাছাড়া দেশে ইরি উৎপাদন ভালো হয়েছে। সামনে আমনও ভালো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে কোনো সিন্ডিকেট চালের বাজার অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালালে সে মিশন ভেস্তে যাবে।

জেএন/পিআর

KSRM
আরও পড়ুন
লোড হচ্ছে...
×KSRM