‘জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে এর অপব্যবহার ও অমর্যাদা রোধ করতে হবে’

জিয়া হাবীব আহসান : জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন প্রত্যেক নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন দেশ ও লাল সবুজের পতাকা পেয়েছি। যত্রতত্র ছেড়া, রংচটা, কোঁচকানো,রং বিকৃত,ভুল সাইজ, মোচড়ানো, বিকৃত ভাবে তৈরি পতাকা ব্যবহার শাস্তি যোগ্য অপরাধ। শুধু সঠিক সাইজ ও সঠিক রং হলেই চলবে না এটা কখন, কোথায় ব্যবহার হবে,কে কখন ব্যবহার করতে হবে বা পারবেন,কিভাবে জাতীয় পতাকা অর্ধনিমিত করা হয় ইত্যাদী নিয়ম কানুন আমাদের পতাকা বিধিতে সূস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। জাতীয় পতাকার অবমাননা দেশ ও জাতির প্রতি অবমাননাকর আচরণও বটে।

- Advertisement -

জাতীয় পতাকার রংয়ের ব্যাখ্যা : –

- Advertisement -google news follower

বাংলাদেশের সংবিধানের ৪নং অনুচ্ছেদের ২নং দফায় বলা হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকা হবে সবুজ জমিনের উপর খচিত রক্ত বর্ণের ভরাট বৃত্ত। জাতীয় পতাকার রং হবে বটল গ্রীণ (Bottle Green )। সবুজ রং হবে Procion Brilliant Green H-2RS 50 Parts par 1000 . এর মধ্যে একটি লাল বৃত্তের রং হবে Procion Brilliant Green H-2RS 60 Parts par 1000. সবুজ রং তারুণ্যের উদ্দীপনা ও চির সবুজ গ্রামবাংলার সবুজ পরিবেশের প্রতীক। আমাদের জাতীয় পতাকায় স্বাধীনতার প্রাণস্পন্দনে যৌবনের নব- উন্মেষ ও কর্মোন্মাদনার চাঞ্চল্যকে এর ব্যবহারে রূপদিতে হলে সবুজ রং এর প্রয়োগ ছাড়া অন্য কোন রং সার্থকতর ও শোভনতর হতো না। লাল রং ২৫ মার্চের কালো রাত্রের অবসান ঘটিয়ে ছিনিয়ে আনা লাল সূর্যের প্রতীক। আমাদের জাতীয় পতাকায় সবুজের বুক চিরে উদীয়মান সূর্যের রক্তিম গোলক খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বংগজননীর মন মুগ্ধকর রূপটি বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছে উদীয়মান সূর্যগোলকটি। যা বিশ্বের ঘুমন্ত জাতি গুলোকে এক দিকে যেমনি সচেতন করে তোলার সংকেত বহন করে, অন্যদিকে তেমনি পৃথিবীর নিপীড়িত, নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, শোষিত এবং পরাধীন জাতির প্রাণে নব প্রেরণা ও নবীন উম্মাদনা সৃষ্টি করছে। স্বাধীনতা মানুষের প্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয়, পবিত্রতম অধিকার হতেও অধিক পবিত্র। যা মানুষের মহার্ঘতম বস্তুর চেয়েও অধিক মূল্যবান। ‘জাতীয় পতাকা’ জাতির নিকট পবিত্র ও মূল্যবান বলে তা যত্রতত্র, যখন তখন, ব্যবহার করা উচিত নহে। সাধারণতঃ বিশেষ রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় অনুষ্ঠানেই ‘জাতীয় পতাকা’ ব্যবহৃত হয়। সরকারী ভবনে সব সময় জাতীয় পতাকা থাকতে হয়। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ‘জাতীয় পতাকাকে’ অভিবাদন করার রীতি ও প্রচলিত আছে।

আমাদের জাতীয় পতাকা তৈরীর সঠিক নিয়ম:-
দৈর্ঘ্য = ১০ ইউনিট: প্রস্থ = ৬ ইউনিট আকারের আয়তাকার (Recetangular )। বৃত্তের ব্যাসার্ধ = দৈর্ঘ্যের ৫ ভাগের ১ ভাগ। প্রস্থকে ৩ ইউনিটে ভাগ করতে হবে। দৈর্ঘ্যকে বামে ৪জত(১,২) ইউনিটে এবং ডানে ৫জত(১,২) ইউনিট এ ভাগ করে সরল রেখা (Horizontal Line ) টানলে দৈর্ঘ্য প্রস্থ বিভাজন-কারী রেখাদ্বয়ের মিলন বিন্দুই হবে বৃত্তের কেন্দ্র বিন্দু। অর্থাৎ লাল বৃত্তটির ব্যাসার্ধ পতাকার দৈর্ঘ্যের এক পঞ্চমাংশ হবে। বৃত্তের রং হবে লাল বাকী অংশ সবুজ।

- Advertisement -islamibank

পতাকার আকার (সাইজ):-
(ক) ভবনের জন্য পতাকা:- (১) ১০ * ৬ (২) ৫ * ৩ (৩) ২.৫ * ১.৫। পতাকার আকার ভবনের আকার অনুযায়ী হবে এবং সরকার প্রয়োজনবোধে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের পরিমাপ বজায় রেখে প্রস্তুতকৃত বৃহদাকার পতাকা প্রদর্শনের অনুমতি দিতে পারেন।
(খ) গাড়ির জন্য পতাকা:- (১) ১৫ * ৯ (বড় গাড়ি জন্য); (২) ১০ * ৬ (ছোট ও মাঝারি গাড়ির জন্য)।
গ) আন্তর্জাতিক ও দ্বিপাক্ষিক সম্মেলনের জন্য টেবিল পতাকার আকার:- ১০ * ৬।

পতাকার মর্যাদা রক্ষা: পতাকার মর্যাদা রক্ষার জন্য কিছু (বিধি-৭, জাতীয় পতাকা বিধিমালা, ১৯৭২) নিয়ম মেনে চলতে হয়। যেমন:- সবসময়ই পতাকার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। পতাকা কোন অবস্থাতেই কোন যানবাহন, রেল বা নৌকার উপরে, পার্শ্বে বা পেছনে জড়িয়ে রাখা যাবে না। অন্যান্য দেশের পতাকা বা নিশানের সাথে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হলে, বাংলাদেশের পতাকার জন্য সম্মানিত স্থানটি বা ‘প্লেস অব অনার’ সংরক্ষিত রাখতে হবে। যদি পতাকা বা নিশানের সংখ্যা দুটি হয় তবে বাংলাদেশের পতাকা ডান পার্শ্বে উত্তোলন হবে। পতাকার সংখ্যা দুয়ের অধিক হলে, বেজোড় সংখ্যার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকা কেন্দ্র স্থলে এবং জোড় সংখ্যার ক্ষেত্রে কেন্দ্রস্থলের ডান পার্শ্বের প্রথম স্থানে উত্তোলন করতে হবে। অন্য কোন পতাকার সঙ্গে আড়াআড়িভাবে পতাকা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকাটি Crossed flag এর ডান পার্শ্বে থাকবে। অর্থাৎ পতাকার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে বাংলাদেশের পতাকাটি উক্ত দাঁড়ানো ব্যক্তির বামদিকে থাকবে এবং পতাকার দন্ডটি অন্য পতাকার দণ্ডের সামনে থাকবে। অন্য কোন পতাকা বা নিশান বাংলাদেশের পতাকার চেয়ে উঁচুতে উত্তোলন করা যাবে না। শোভাযাত্রার (Procession ) কেন্দ্রস্থল অথবা শোভাযাত্রার অগ্রযাত্রা সারির ডান পার্শ্বে পতাকা বহন করতে হবে। শীলড বা পদকে (Esutcheon ) বেজোড় সংখ্যা পতাকার ক্ষেত্রে কেন্দ্রস্থলে এবং সবচেয়ে উপরে (Highest point ) এবং জোড় সংখ্যক পতাকার ক্ষেত্রে শীলড্‌ বা পদকের ডান পার্শ্বে (অর্থাৎ পতাকার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে দাঁড়ানো ব্যক্তির বাম পার্শ্বে) থাকবে। অন্যান্য দেশের পতাকার সাথে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকা সর্ব প্রথমে উত্তোলন করতে হবে এবং সবশেষে নামাতে হবে। পতাকা কবরে নামানো যাবে না এবং মাটিকে স্পর্শ করা যাবে না। পতাকা কোন ব্যক্তি বা জড় বস্তুর সাথে জড়ানো যাবে না। পতাকাকে সর্বদাই ঊর্ধ্বে রেখে মুক্তভাবে বহন করতে হবে। উচ্চ মাপের সম্মানিত ব্যক্তির কফিন বা মরদেহ পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় বা পূর্ণ আনুষ্ঠানিকতায় পতাকার আচ্ছাদনে দাফনের অনুমতি প্রদান করা যাবে।

যেমন: স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কফিন বা মরদেহ। সরকারের লিখিত অনুমতি ছাড়া পতাকা কোন ট্রেড মার্ক, ডিজাইন, বৃত্তি, পেশায় বা অন্য কোন উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা যাবে না। পতাকা ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়লে যথাযথ মর্যাদার সাথে বিহীত ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে পুড়িয়ে ফেলাই শ্রেয়। পতাকা সতেজ কর্মচঞ্চল দ্রুততার সাথে উত্তোলন ও সাড়ম্বরে নামাতে হবে। পতাকা উত্তোলন ও নামানোর আনুষ্ঠানিকতার সময় কিংবা পতাকা প্যারেড অতিক্রমের সময় উপস্থিত সকল ব্যক্তি পতাকার দিকে মুখ করে সম্মান প্রদর্শন সূচক ভঙ্গিতে (Attention ) দাঁড়াবেন। আনুষ্ঠানিকতার সাথে হলে জাতীয় সংগীতের তালে তালে পতাকা উত্তোলন করতে হয়। গাড়ী নৌযান বা বিমান ব্যতীত পতাকা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উত্তোলিত থাকবে। তবে সংসদের নৈশ অধিবেশন কিংবা রাষ্ট্রপতি ও কেবিনেট মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের সময় রাতের বেলায় ও ভবন শীর্ষে পতাকা উত্তোলিত রাখা যাবে। পতাকায় কোন কিছু লেখা বা প্রিন্ট করা যাবে না বা এতে কোন চিহ্ন প্রদান করা যাবে না। জাতীয় পতাকা বিধিমালা অনুসরন না করে এর ব্যবহার করা যাবে না।

একটি স্বাধীন দেশ ও সচেতন জাতি হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা আমাদের অবশ্যই কর্তব্য। যেহেতু আমাদের দেশের অধিকাংশ নাগরিক এ ব্যাপারে অজ্ঞ, তাই তাদের এ ব্যাপারে সতর্ক করানোর জন্যে ব্যাপক প্রচার- প্রোপোগন্ডার প্রয়োজন। আমাদের দেশের জাতীয় প্রচার মাধ্যমসমূহে রীতিমত কত রকমারি অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে। অথচ জাতীয় জীবনে সচেতনতা আনয়নের ক্ষেত্রে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির দিকে কারো নজর নেই। এ ব্যাপারে লেখকের মতে আমাদের দেশের সমস্ত ভুল নিয়মে প্রস্তুত পতাকা সমূহকে বাজেয়াপ্ত করে সঠিক এবং সুষ্ঠু নিয়মে পতাকা প্রস্তুত করে তা সরকারিভাবে জনগণের কাছে সরবরাহ করা প্রয়োজন।

নির্ভুল পতাকা সরবরাহের এ- দায়িত্ব কোন কোন সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান, এন.জি.ও. এবং মানবাধিকার সংগঠন সমূহ কর্তৃকও পালিত হতে পারে। ভুল নিয়মে পতাকা প্রস্তুত করলে শাস্তি কিংবা জরিমানার ব্যবস্থা করলেও এ খাম খেয়ালীপনা দূর হতে পারে। ভুল জাতীয় পতাকা নির্ণয় ও বাজেয়াপ্ত করার জন্যে একটি কমিটিও গঠন করা যেতে পারে। এব্যাপারে জনগণকে সচেতন করানোর জন্যে ব্যাপক প্রোগ্রাম গ্রহণ করা (ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত) প্রত্যেকের অবশ্য কর্তব্য ও দায়িত্ব বলে লেখক মনে করেন। সকল বসত বাড়ি, দোকান পাটে যেন সঠিক জাতীয় পতাকা অবশ্যই থাকে, সে ব্যাপারে সরকারের কড়া নির্দেশ প্রদান করা প্রয়োজন। অনেক সময় বিকৃত, কুচকানো, রং চটা ও অতি পুরানো যে সব পতাকা দৃষ্টির গোচরে আসে সেগুলো উৎখাত করে সঠিক জাতীয় পতাকা প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণও জরুরি। এ ব্যাপারে প্রশাসনের পাশাপাশি সচেতন শিক্ষিত নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে। শুধু মাত্র বয়স্কাউট্‌সদেরকেই এ পতাকা অংকনের সঠিক পদ্ধতি শেখানো হয়। লেখক এপ্রেরণা ও অনুভূতি সেখান থেকেই পেয়েছেন।

উপসংহার:- স্বাধীন বাংলাদেশবাসীর জাতীয় জীবনে জাতীয় পতাকার মর্যাদা অপরিসীম ও সর্বোচ্চ। এটা আমাদেরকে আত্ম প্রতিষ্ঠিত ও উন্নত জাতিতে পরিণত করার প্রেরণা যোগায়। এ- পতাকা অর্জনে এত বেশি মূল্য দিতে হয়েছে যে বিশ্বের কোন দেশ বা জাতিকে এত মূল্য দিতে হয়নি, ইতিহাস তার সাক্ষ্য।

সুতরাং আমরা অনেক মূল্যে যাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং আমাদের হাতে যার গৌরব ও মর্যাদা রক্ষার ভার, আমরা বেঁচে থাকতে সে জাতীয় পতাকার পূর্ণ গৌরব বজিয়ে রাখবোই, রাখবো ইনশাআল্লাহ। এটা দেশ ও জাতির পবিত্র আমানত। আমাদের কঠোর শপথ ও দুর্বার প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে যে কোন মূল্যে বা চরম ত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে এমনকি জীবনের বিনিময়ে হলেও আমরা এ আমানতের যথাযোগ্য সংরক্ষণ ও মর্যাদা রক্ষা করবো।

লেখক, আইনবিদ, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী, কলামিস্ট এবং মহাসচিব, বাংলাদেশ হিউম্যান রাইট্‌স ফাউন্ডেশন- বি.এইচ.আর.এফ

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM