মশার মশকরায় নাভিশ্বাস চট্টগ্রামবাসী

সৃষ্টি দে : চট্টগ্রাম নগর কিংবা জেলা-উপজেলা প্রায় সবখানেই এখন বিরাজ করছে মশার যন্ত্রণা। দিনে মশা। রাতেও মশা-যেখানে যাচ্ছি সেখানেই মশা। শিশু থেকে বৃদ্ধ প্রত্যেকে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।

- Advertisement -

ইলেকট্রিক ব্যাট, অ্যারোসল, কয়েল জ্বালিয়েও মশার অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়া মুশকিল। এ যেন দিনরাত পরিশ্রমের টাকা দিয়ে বসতঘর ভাড়া নিয়ে মশাদের আশ্রয়স্থল বানাচ্ছে মানুষ। রীতিমতো প্রায় এলাকায় বিভিন্ন জনের বসতঘর এখন মশাদের দখলে।

- Advertisement -google news follower

শুধু বাসায় নয়, দিনের বেলাতে অফিস-আদালত, মার্কেট, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশনসহ মানুষের উপস্থিতি স্থানে মশার উপদ্রব অস্বভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।

মশার গুন গুন সোনা বন্ধুর গানের শব্দে দিনে-রাতে ঘুম আসে না। এমন বড় বড় মশা শরীরের জামা উপর কামড় মারে, লালার মশা এত বেয়াদব জামা ভিতরে ডুকেও কামড় মারে।

- Advertisement -islamibank

মশা মারতে গিয়ে কখনও গালে, কখনও কপালে আবার কখনও পায়ে এমনকি কানে নিজের চড় নিজেকেই খেতে হচ্ছে। এ চিত্র এখন প্রায় প্রতিটি ঘরে নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরীর পাথরঘাটা ইকবাল রোড শফি কলোনীর বাসিন্দা নুর আলম বলেন, অবস্থা এমন বেগতিক যে,সন্ধ্যার আগেই বাসায় মশারি টানানো এখন নিত্যদিনের প্রধান কাজ।

একই এলাকার রাজীব নুর জানান, করপোরেশনকে অনুরোধ করবো, একবার এসে এলাকায় ঘুরে যান, তাহলে দেখবেন এলাকায় জনগণের চাইতেও মশা আছে হাজার গুন বেশি।

আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা রোজিনা রুজি বলেছেন, মশার ঔষধ ছিটিয়ে কাজ হচ্ছে না, তার মানে হলো ঔষধ নিম্নমানের দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে মেয়র সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

আবার রাসেদুল নামে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক ছাত্র বলেন, মশার ওষুধ যত আমদানী তত সুবিধা। ঔষধ না ছিটাইয়াও বলা যাবে ছিটাইছি। কারন কতটুকু ছিটাইছে তার কোনো পরিমাপ নাই। তাছাড়া ছিটাইছে পানি আর ডেলিভারী নিছে ঔষধ। এই আর কি?

চট্টগ্রাম নগর কিংবা বিভিন্ন উপজেলা পৌর সদরে বেলা গড়াতেই একটু ভালভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে এডিস মশার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কিউলেক্স মশা। বড় আকৃতির এই মশার যন্ত্রণায় ঘরে থাকাই দায় হয়েছে।

কিউলেক্স মশা
কিউলেক্স মশা । সংগৃহীত ছবি

নগরীর বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা রহুল আমিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মশা এত বেড়েছে যে আর কিছু দিন গেলে বাসা বাড়িতে নয় সবাই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের বেডে থাকতে হবে।

অনেকেরই অভিযোগ চসিক/পৌর মেয়র কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মশা নিধনে ওষুধ ছিটানোর কোনো উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়নি।

ফলে যে যার মতো পারছে মশা থেকে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করছে। আর সাধারণ মানুষের এ অসহায়ত্বের সুযোগে বাজারে মশা তাড়ানোর ওষুধ ও পণ্যের দাম বহুগুন বেড়ে গেছে।

একটু অন্ধকার হলেই ঝাঁকে ঝাঁকে বাসাবাড়িতে হানা দিচ্ছে মশা। মশার উৎপাতে নগরবাসীর যেমন ত্রাহি অবস্থা, পাশাপাশি বাজারে থাকা মশা মারার উপকরণের রমরমা। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীর মুখ উজ্জ্বল।

এ বিষয়ে মিরসরাইয়ের গণমাধ্যম কর্মী আশরাফ উদ্দিন বলেন, দ্রব্যমূল্যের উদ্ধগতিতে এমনিতেই খুব বাজে অবস্থা তার উপর সংসারে এখন বাড়তি খরচ দৈনন্দিন মশা নিধনের ব্যবস্থা করতে কাড়ি কাড়ি টাকা গুনা।

তিনি হাসির ছলে বলেছেন, মশা বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানিমুখী হলে দেশে একটাও মশা থাকবে না।

আবার টাকা দিয়ে কিনে মশা নিধনের নানান পদ্ধতি অবলম্বল করলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বলেও অভিযোগ নানাজনের। পটিয়া উপজেলার ২ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা শিক্ষক সুমন দাশ জানালেন, মশার কয়েল সারা ঘরে জ্বালালেও মশা যেতে চায় না।

ইন্ডিয়ান গুডনাইট অন করে রাখলে মশা গুডনাইটকে ঘিরে ঘুরতে থাকে। কয়েল জ্বালালে কয়েলের উপর দিয়ে ঘোরে। এ কারণে মশা মারার ইলেকট্রিক ব্যাট ক্রয় করেছি। যতক্ষন মারি ততক্ষণ, আবারো ঘিরে ধরে ফের মশা ভনভন করে।

চট্টগ্রাম নগরী ও পটিয়া পৌর সদরের কয়েকটি এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, খাল ও নর্দমা ছাড়াও বস্তি, রাস্তার পাশের ময়লার ভাগাড়, বাসস্ট্যান্টের বিভিন্ন খোসা, ঝোপঝাঁড়, টায়ারের দোকান, দীর্ঘদিন ধরে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা মোটর যান মশা জন্মানোর উপযুক্ত স্থান।

এছাড়া ঢালাই মেশিন, রাস্তার পাশে পরে থাকা পলিথিন, কর্কসীট, বিভিন্ন মার্কেটের পরিত্যাক্ত ছাদ, দুই বাড়ির মাঝের পেসেজে বৃষ্টির পানি ও ভবনের টাংকীর পানি জমে সেখানে মশা জন্মাচ্ছে।

ছাদকৃষি যারা করেন তাদের বাগানে ফুলের টবে পানি জমে মশার লার্ভা জন্মায়। নির্মাণাধীন ভবনে বেশি মশা দেখা যায়। নির্মাণাধীন ভবনে ঠিকাদার ও বাড়ি মালিকদের অসচেতনায় সেখানে জন্ম নিচ্ছে এডিস ও কিউলেক্স উভয় ধরনের মশা।

সকাল বিকাল ঠিক মত মশার ওষুধ না ছিটানোর কারণে মশার উৎপাত বেড়েই চলছে। দিন দিন মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে রোগী ভর্তির সংখ্যা বাড়ছে। একের পর এক ঘটছে প্রাণহানিও।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপ সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার আনোয়ারা শিরীন জয়নিউজবিডি ডটকমকে বলেন, হঠাৎ করে জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে।

এদের বেশীর ভাগের ডেঙ্গুর উপসর্গ থাকায় ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে দেয়া হচ্ছে, রিপোর্টে অধিকাংশই ডেঙ্গু পজিটিভ আসছে। যাদের প্লাটিলেট কম তাদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরমর্শ এবং বাকিদের প্রেসক্রিপশন দিয়ে বাড়িতে নিরাপদে থাকতে বলা হচ্ছে।

তিনি বলেন, সবাইকে মশারী খাটানোর কথা বলছি এবং যারা এখন রাত জেগে বিশ্বকাপ উপভোগ করছেন তারা যেন মশা থেকে নিরাপদ থাকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন সেই পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

অন্যদিকে মশার উপদ্রব থেকে বাঁচতে মণিষা সেন নামে এক গৃহিণী পরামর্শ দিয়েছেন, হাড়িতে পানি রাখুন। মশা সেখানে বসলে ঢাকনা দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিন এবং কয়েক টুকরা বরফের টুকরা হাড়িতে ফেলুন।

এদিকে এডিশ মশার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া কিউলেক্স মশার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মতে, কিউলেক্স মশার কারণে ফাইলেরিয়া ও ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। নভেম্বর থেকে শুরু করে মার্চ পর্যন্ত এর উৎপাত থাকে বেশি। বিশেষ করে শহরে কিউলেক্স মশার উপদ্রব বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্ত্রী কিউলেক্স মশার মাধ্যমে অসুস্থ ব্যক্তির শরীর থেকে সুস্থ ব্যক্তির শরীরে ফাইলেরিয়া সংক্রমণ হতে পারে। এতে গোদ নামে পরিচিত একটি রোগ হতে পারে। এ রোগের প্রভাবে হাত পা ফুলে যায় ও বারবার জ্বর হয়।

যদিও বাংলাদেশে গোদ ছড়ানোর আশঙ্কা কম। কারণ কিউলেক্স মশা প্রায় ১০ হাজার বার কামড়ালে এই রোগ হয়। এর সঙ্গে রোগী কৃমি রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

নন্দনকানন এলাকার বাসিন্দা পুস্পিতা বলেন, গোটা নগরজুড়েই মশার উপদ্রব অসহনীয় মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। সূর্য ঢলে পড়তেই ঘরে-বাইরে মশার যন্ত্রণা শুরু হয়। আর মশক দমনে করপোরেশনের কার্যক্রম আগে ‘নামমাত্র’ দেখা গেলেও এখন দেখাই যায় না।

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ দরকার সেসব ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের দুর্বলতা রয়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পাদন করা গেলে মশার উপদ্রব এত বৃদ্ধি পেত না।

অবশ্য মশা নিধনে সর্বোচ্চভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন জানিয়ে সিটি করপোরেশন থেকে বলা হচ্ছে, চট্টগ্রাম নগর জুড়ে যতগুলো নালা নর্দমা আছে ধাপে ধাপে সবগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে।

গাপ্পি মাছ ছাড়া হয়েছে, কালো তেল দেয়া হয়েছে এটা খুব কার্যকর। কচুরিপানা পরিষ্কার করার পর এসব স্থানে লার্বি সাইট প্রয়োগ করা হচ্ছে। প্রত্যেকটি বাড়িতে পানির মধ্যে ট্যাবলেট প্রয়োগ করার পাশাপাশি ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে সতর্ক করা হচ্ছে।

গাপ্পি মাছ
গাপ্পি মাছ | সংগৃহীত ছবি

যতগুলো মশার হটস্পট আছে সেগুলোকে নির্দিষ্ট করে মূলত করপোরেশনের কর্মীরা কাজ করে যাচ্ছে এবং প্রত্যেকটি এলাকায় আলাদাভাবে জনপ্রতিনিধিরা মশক নিয়ন্ত্রক সুপারভাইজারদের সাথে নিয়ে মিটিং করছে।

জেএন/পিআর

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM