বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন দেশে পুনর্বাসন জরুরি

বাংলাদেশ স্বাধীনের পর থেকেই রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্প ছিল অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থল। মিয়ানমার বা বার্মা থেকে বিতাড়িত মানুষরা সেখানে আশ্রয় নিয়ে কোন প্রকার খেয়ে পড়ে বেঁচে ছিল। বাংলাদেশ সরকারের নিবন্ধিত শরনার্থী শিবিরে ছিল মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা মানুষদের মধ্যে সৌহার্দ ও ভ্রাতৃর্থবোধ। হানাহানি, খুনাখুনিসহ নানা অপরাধে পা দেননি তারা। বিগত ৩১ বছরে বাংলাদেশের নিবন্ধিত শরানার্থী শিবিরে একটাও খুনের নজির নেই।

- Advertisement -

আমরা ১৯৯২ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছি।  ৩১ বছরে নিবন্ধিত শরনার্থীরা জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা বা ইউএনএইচসিআর এর সহযোগিতায় বাংলাদেশের সকল প্রকার আইন বিধি-কে শ্রদ্ধা করে বসবাস করছি। গত কয়েক বছর ধরে পরিস্থিতি পাল্টে গেল রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবিরগুলোতে। এতে রাক্ষুসের নজর পড়েছে। ‘আরসা’ অর্থাৎ আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি নামক রোহিঙ্গা বিদ্রোহী দলের অপতৎপরতায় শরনার্থী ক্যাম্পগুলোতে ইদানিং ঘটছে একের পর এক অঘটন, সংঘাত, সংঘর্ষ ও রক্তপাত। আরসার অপচেষ্টার কারণে এ অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো ঘটছে বলে এদেশীয় প্রশাসনের ধারণা।

- Advertisement -google news follower

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ২০১৬-র ডিসেম্বর মাসের রিপোর্ট অনুসারে, আরসার নেতৃত্ব দেন আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি নামে পাকিস্তানের করাচীতে জন্ম নেয়া একজন রোহিঙ্গা। যিনি সৌদি আরবের মক্কায় বড় হয়েছেন। এছাড়া সৌদি প্রবাসী রোহিঙ্গাদের একটা কমিটিরও নেতৃত্বে আছেন তিনি।

বাংলাদেশ সরকার কৌশলগত কারণে শরণার্থী ক্যাম্পে ‘আরসার’ অস্তিত্ব অস্বীকার করে আসছে। তবে রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পে যে কোন হত্যাকান্ডের পর আরসা  হত্যার দায় স্বীকার করে আসছে। এতে বাংলাদেশ সরকারও অস্বস্তিতে পড়ছে। তারা বাংলাদেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চায়। তাই পরিকল্পিতভাবে নানা নৈরাজ্যের পাশাপাশি অপপ্রচারে লিপ্ত। এভাবে চলতে দেওয়া যায় না।

- Advertisement -islamibank

আমি নিজেও একজন নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরনার্থী। জাতিসংঘের আইন মেনে আমরা বাংলাদেশে শরনার্থী হিসেবে আছি প্রায় ৩২ বছর। এক সময়  ক্যাম্পে নানা সুবাতাস বইলেও এখন সে পরিস্থিতি নেই। এখন আগের মতো স্থিতিশীলতা নেই। ভ্রাতৃত্যবোধ নেই। সহমর্মিতা নেই। এখন অজানা এক বিশৃঙ্খলতার দূত ঘুরপাক খাচ্ছে রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পগুলোতে।

আসরার পেত্তাত্বারা ‘অদৃশ্যভাবে’ রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর মানুষের ভালোমন্দ নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের কথায় দেশত্যাগী, শোষিত-বঞ্চিত, পরাস্ত, পযুদস্ত মানুষগুলো উঠ-বস করছে। আরসা ক্যাম্পগুলোতে নিজেদের স্টাইলে আইন আদালত বসিয়ে লাখ লাখ শরণার্থীর বাচ-বিচার করছে। খুন, ধর্ষণ, অপহরণের মতো নানা অপরাধ করছে। কেউ টু শব্দও করতে পারছে না সেখানে। আসলেই আমাদের সত্যিকারের সুশিক্ষিত উচ্চতর ডিগ্রিধারী নেতার অভাব। নেতা মুহিব উল্লাহকে নির্মমভাবে খুন করার পর নেতৃত্ব সংকট সৃষ্টি হয়েছে রোহিঙ্গা শিবিরে। সামনে এ পরিস্থিতি ভয়ানক হতে পারে এমন ধারণা করছে গোয়েন্দা সংস্থাসহ অনেকেই। এতে আমাদের আশ্রয় দেওয়া মানবতার দেশ, মানবতার মা শেখ হাসিনার জন্মভূমি বাংলাদেশ অস্থিরতায় পতিত হবে এমন শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। এভাবে প্রায়শ ঘটছে খুনাখুনি। কেউ দায় স্বীকার করুক বা না করুন হত্যাকান্ডের জন্য আরসার সংশ্লিষ্টতার কথা মানুষের মুখে মুখে।

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই ঘটেছে পাঁচটি খুনের ঘটনা। এ ছাড়া শিবিরে চুরি-ডাকাতি, ধর্ষণ, অপহরণ, মাদক ও অস্ত্রপাচারসহ নানা অপরাধের ঘটনা লেগেই আছে।

প্রশাসনের কঠোর নজরদারি সত্ত্বেও সশস্ত্র রোহিঙ্গারা তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে দিন দিন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সাধারণ রোহিঙ্গারা। তারা সবসময় আতঙ্কে দিনযাপন করছেন বলে জানিয়েছেন।

গত ৩ অক্টোবর উখিয়ার ১৮ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে তামদিয়া আক্তার নামে ১১ বছরের এক রোহিঙ্গা শিশু নিহত হয়েছে। একই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তার ভাবি দিল ফায়াছ (১৮)। ১১ অক্টোবর ৯ নম্বর শিবিরের আই ব্লকে দুষ্কৃতকারীদের গুলিতে হেড মাঝি (কমিউনিটি লিডার) মোহাম্মদ হোসেন (৩৮) নিহত হন।  ১৫ অক্টোবর  সন্ধ্যায় উখিয়ার বালুখালী ১৩ নম্বর ক্যাম্পে ১৮/এ ব্লকে সন্ত্রাসীদের কুপানিতে এফ ব্লকের হেড মাঝি মো. আনোয়ার এবং সহকারী মাঝি মৌলভী মো. ইউনুস মারা যান। ১৮ অক্টোবর উখিয়ায় বাবার পর ছেলে সৈয়দ হোসেন (২৩) নামে এক রোহিঙ্গাকে গলা কেটে ও গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটে। কতিপয় দুষ্কৃতকারীরা এর আগে ২০২১ সালে তার বাবা জমিল হোসেনকে খুন করে।সর্বশেষ ২৬ অক্টোবর মোহাম্মদ সালাম (৩৭) ও জসিম উদ্দিন (২৩) খুন হন।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুনাখুনির ঘটনায় লজ্জিত আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ।  বাংলাদেশ আমাদের আশ্রয় না দিলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতাম পুরো পরিবার পরিজনসহ। তাই বাংলাদেশ আমাদের ভালোবাসার দ্বিতীয় স্থান। তাই বাংলাদেশের সকল বিপদ আপদে আমরাও নিজেদের উজাড় করতে চায়। সিলেটের বন্যাদুর্গতের ৪০০ পরিবারকে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ এবং  সীতাকুন্ড বিএম ট্রিজেডি কন্টেইনার বিষ্ফোরণে ভয়াবহ আগুনের আহতদেরকে রক্তদানসহ নগদ অর্থ ও ঔষধপত্র দিয়ে সহযোগিতার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল নিবন্ধন রোহিঙ্গা শরনার্থীরা। বাংলাদেশের এমন কঠিন বিপদের সময় পাশে থাকতে পারে আমারা গর্বিত হয়েছিলাম। তবে এখন আমারা নিজেদের মানুষের কাছে নিজেরাই অনিরাপদ।

আবাসন, খাদ্য ও চিকিৎসার সমস্যা রয়েছে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রায় ৫ হাজার পরিবারে। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া নিবন্ধিত ৯০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকাসহ বিভিন্ন  দেশে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। কিন্তু ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার এ পুনর্বাসন প্রক্রিয়া স্থগিত করে।

ডব্লিউএফপি সহযোগিতায় যে রেশন ননফুট সাধারণ শরণার্থীদের দেওয়া হয়, তা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা সহজ নয়। গত চার বছর ধরে প্রায় ৩০০ নিবন্ধিত পরিবার প্রত্যাহার করেছে ডব্লিউএফপির রেশন, তাদের  একমাত্র দাবি ডিউরেবল সল্যুশন চাই তারা অথবা পুনর্বাসন চাই।

কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে যাদের জরুরি চিকিৎসা দরকার যেটা নানা কারণে সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া কিছু নিবন্ধিত শরণার্থীর পরিবারের সদস্যদের আগে বিভিন্ন দেশে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তারা যাতে তাদের পরিবারের সাথে একত্রিত হতে পারে এবং যাদের চিকিৎসা দরকার তারা যাতে সে সুবিধা পায় সে ভিত্তিতে নিবন্ধিত শরনার্থীদের বাছাই করে পূনর্বাসন করা জরুরি।

বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থার প্রতি  আহবান নিবন্ধিত শরনার্থীদের দ্রুত সময়ে পুনর্বাসন করুন। আমারা শ্বাস নিতে চাই, আমার মুক্ত হতে চাই, আমারা আমাদের অধিকার চাই, আমরা উচ্চ শিক্ষিত হতে চাই। একজন নাগরিকের কাছে ‘শরণার্থী’ পরিচয়টি লজ্জার বিষয় বলে মনে হয়।

বিশ্বনেত্রী ও মানবতার মা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাইলে এদেশের বাইরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের উদ্যেগ নিতে পারেন।

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM